অধিকার আদায়ে বীরদর্পে গর্জে ওঠা বা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়া বাঙালি জাতির পুরানো ইতিহাস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে আন্দোলন, লড়াই একটি বড় ঐতিহ্য। তারই ধারাবহিকতায় ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও যুদ্ধে মেতে উঠেছিল বাঙালীরা।
বাংলাদেশ আবিচ্ছেদ্য অংশ নেত্রকোণার স্বাধীন চেতা জনগোষ্ঠী ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিতাসিক ভাষণের সারংশ শুনেই অনুধাবন করতে পেরেছিল তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে যেতে হবে। তাই মুক্তিযুদ্ধের জন্য নেত্রকোণাবাসীকে প্রস্তুতি গ্রহণে বেশি সময় ব্যয় হয়নি। ৭ মার্চ এর পর থেকেই নেত্রকোণার প্রত্যেক থান শহরগুলোতে যুদ্ধে যাবার জন্য যুব সমাজ উদগ্রীব হয়ে ওঠে। প্রতিদিন থানা পর্যায়ে গ্রামগুলো থেকে হাজার হাজার মানুষ সশস্ত্র মিছিল করে আসতে থাকে। নেত্রকোণা শহরসহ থানা শহরগুলোর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান মানুষগুলোও নীতি নির্ধারণের কাজ শুরু করে দেয়।
নেত্রকোণা ছাত্রলীগের সম্মেলনের দিন থেকেই নেত্রকোণায় আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল। মূল সূচনা ছিল ৩ মার্চ নেত্রকোণা মহুকুমা ছাত্র-লীগের উদ্যোগে মিছিলেই। এর পর থেকেই প্রতিদিন নেত্রকোণা মিছিল আর মিছিল। ২৩ মার্চ নেত্রকোণা মোক্তারপাড়া মাঠে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকায় অগ্নিসংযোগ ভষ্ম করা হয়, এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিক ভাবে উত্তোলন করা হয়। ২৭ মার্চ নেত্রকোণা আওয়ামীলীগ অফিসে নেত্রকোণা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সে দিন থেকে শহরের অবস্থা আরো ভয় ও শঙ্কায় নিমজ্জিত হতে থাকে। রাজনৈতিক অঙ্গন হয়ে ওঠে চঞ্চল। নেত্রকোণা শহরের বর্তমান জনতা হোটেল, সমতা বেকারী, আওয়ামীলীগ অফিসের পাশে ততকালীন চৌধুরীর স্টল, স্টেশন রোডে নদীর উপর ততকালীন জলযোগ রেস্তোরা ও কলেজ ক্যান্টিনের রাজনৈতিক আড্ডাগুলোতে যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নেয়ার কথার প্রাধান্য বেশি পায়। থানা শহর গুলোতেও একই অবস্থা। সকলেই তখন যুদ্ধে যাবার শুধুই প্রহর গুণছিল। ১২ এপ্রিল নেত্রকোণা মহুকুমা পুলিশ প্রশাসককে স্থানীয় যুকরা আটক করে ফেলে। সে দিনই পুলিশ প্রশাসনের অস্ত্রাগার থেকে ৩শ রাইফেল সংগ্রহ হয়। নেত্রকোণা সরকারী বালিকা বিদ্যালয়কে অস্থায়ী যুদ্ধশিবির নির্ধারণ করা হয়। সেখানেই শুরু হয় অস্থায়ীভাবে প্রশিক্ষণ। যোগদেয় কয়েকজন ই,পি,আর, আনসার, পুলিশ ও প্রা ক্তন সামরিক বাহিনীর সদস্য। অপর দিকে মার্চ মাসের শেষার্ধে জারিয়া হাই স্কুল মাঠে মনির উদ্দিন সরকারের নেতৃত্বেও একটি প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালিত হচ্ছিল। দুর্গাপুর সীমান্ত থেকে ই,পি,আর এর সুবেদার আজিজুল হক ৫টি রাইফেল নিয়ে এসে প্রায় ২’শ যুবককে জারিয়ার প্রশিক্ষণ শিবিরের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। এপ্রিল মাসের প্রথম পক্ষকাল পর্যন্ত সে প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালিত হয়েছিল। নেত্রকোণার প্রায় অধিকাংশ থানা সদরেই স্বাধীনতা কামী মানুষ যুদ্ধের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে ফেলে। গড়ে তোলেছিল প্রশিক্ষণ শিবির। এতে মহুকুমা শহরসহ থানা পর্যায় পর্যন্ত সাধারণ মানুষের মনোবল বৃদ্ধি পায়। সাধারণ মানুষও পাক হানাদারদের প্রতিরোধ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থায় আগ্রহী হয়ে উঠে।
২৩ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে নেত্রকোণা শহরের উপর পাকিস্তানীদের দু’টি সুরমা রং এর যুদ্ধ বিমান গুলি বর্ষণ করে চলে যায়। এতে নেত্রকোণার সাধারণ মানুষ ভীতগ্রস্থ হয়ে পড়ে। প্রশিক্ষণ শিবিরের ই,পি,আর বিষয়টি অনুধাবন করে বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র ছাড়াই রাইফেল দিয়ে বিমানের দিকে গুলি ছুড়ে সাধারণ মানুষের ভীতিহ্রাস করার চেষ্টা করেন। এতে তেমন কোণ ফল আসেনি। দুপুর নাগাদ নেত্রকোণা শহর জনমানব শূন্য হয়ে যায়। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও নেত্রকোণা শহরকে নিরাপদ মনে করেননি।এই দিনই তারা নেত্রকোণা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিবির পূর্বধলায় স্থানান্তর করে। পূর্বধলাকে তারা নেত্রকোণা শহর থেকে অনেক নিরাপদ মনে করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের অর্থ সংগ্রহ করতে ওই রাতে নেত্রকোণা শ্যাশনাল ব্যাংকের Volt ভেঙ্গে টাকা পয়সা ও
সোনো সংগ্রহ করেত।খাদ্য সংগ্রহ করতে জা রিয়া সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে চাল , চিনিসহ প্রচুর খাদ্য সামগ্রী সীমান্তের ওপারে বাঘমারা পাঠিয়ে দেয়। নেত্রকোণা অস্ত্রাগার থেকে সংগৃহিত অস্ত্রসহ বেশ কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন অস্ত্র নিয়ে ভারতের বাঘমারা পাঠিয়ে দেয়। নেত্রকোণা অস্ত্রাগার থেকে সংগৃহীত অস্ত্র বেশ কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন অস্ত্র নিয়ে ভারতের বাগমারা , মহাদেও,রংমা ও মহেষখলার গড়ে তোলে মুক্তি যোদ্ধা ক্যা ম্প। এছাড়া মদন থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে আটক করে তাদের অস্ত্রগুলো নিয়ে মহেশখলা ক্যাম্পকে আরো শক্তিশালী করে তোলে।
ছাত্র ও যুব সমাজের মধ্যে বেশ তৎপরতা লক্ষ্যণীয়। সে সময় গোলাম এরশাদুর রহমান, আশরাফ উদ্দিন খান, শামছুজ্জোহা, সাফায়েত আহমেদ, বাদল মজুমদার, আবু সিদ্দিক আহমেদ, হায়দার জাহান চৌধুরী, গোলাম মোস্তফা, মেহের আলী, গুলজার আহম্মেদ, আনিসুর রহমান, আবু আক্কাছ আহমেদ। মোহনগঞ্জের হীরা, পূর্বধলার আব্দুল কদ্দুছ তাং , আবুল হাসিম, মাহফুজুল হক, মাফিজ উদ্দিন, আব্দুল মান্নান খান, আব্দুল আউয়াল আকন্দ, এখলাছ উদ্দিন, আব্দুল হেলিম, নাজিম উদ্দিন, নিজাম উদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন প্রমুখ ছাত্র ও যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের সাংগাঠনিক কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য রাত দিন শ্রম দিয়েছেন।
২৮ এপ্রিল পর্যন্ত নেত্রকোণা ছিল পাকহানাদার মুক্ত স্বাধীন। পরিবেশ ছিল থমথমে। প্রতিটি মানুষ ছিল শঙ্কিত। ২৯ এপ্রিল (১৫ বৈশাখ ১৩৭৮) সর্ব প্রথম নেত্রকোণা শহরে পাকহানাদার বাহিনীর একটি দল প্রবেশ করে। একই দিনে এরা পূর্বধলায় , পরদিন দুর্গাপুর সদরে প্রবেশ করেছিল। পাশাপাশি সময়ের মধ্যোই নেত্রকোণার জেলার (ততকালীন মহুকুমা) খালিয়াজুরী ব্যতীত সকল থানা সদরে তাদের প্রবেশ কার্য শেষ করে ফেলে। থানা সদর গুলোতে তাদের স্থায়ী ক্যাম্প করে। সে সকল স্থানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে সেতু নির্মাণসহ বিভিন্ন সেতুতে প্রহরা বসিয়ে দেয়। প্রত্যেক সেতুর পাশেই ব্যাংকার নির্মাণ করে তাদের অবস্থান দৃঢ় করে।
পাক হানাদার বাহিনীর অত্রাঞ্চলের ব্রিগেড কমান্ডের দপ্তর ছিল ময়মনসিংহে। অধিনায়ক ছিল ব্রিগেডিয়ার আব্দুল কাদির খান। নেত্রকোণা অঞ্চল ছিল সেই ব্রিগেডের ৭১ উইং রেঞ্জার্স ফোর্সের অধীনে। ২৯ এপ্রিল নেত্রকোণা শহরে পাকবাহিনী প্রবেশ করে পি.টি.ইনষ্টিটিউটে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। আখড়ার মোড়ে সাহা ষ্টুডিওতে মিলিশিয়া ক্যাম্প, জেলা পরিষদের রেষ্ট হাউজে আর্মি অফিসার্স ক্যাম্প, বড় বাজারে সর্বমোহন বণিকের গদিঘরে রাজাকার, আল- বদর, আল-মুজাহিদের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। সর্বমোহন বনিকের দোতলায় পাকহানাদাররা টর্চারর সেল হিসেবে ব্যবহার করে। এ টর্চার সেলে নেত্রকোণার নিরীহ জনসাধারণদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। সেখানে নির্যাতন শেষে থানার পাশে নদীর পাড়, চন্দ্রনাথ স্কুলের পাশে নদীর তীরে অথবা নেত্রকোণা পূর্বধলা রাস্তায় ত্রিমোহনী ব্রিজে এনে গুলি করে সাধারণ মানুষদের হত্যা করা হতো।
---------------------------------------------------------------------------------------------------আলী আহম্মদ খান আইয়োব-----------------------------------
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS