আউল-বাউল-কবিয়াল, গীতালু, বয়াতী, গাইন, ঘুরমা, তামসা গান, যাত্রাগান, কৃষ্ণলীলা, রামমঙ্গলসহ রূপবান, বাইদ্যানী, চন্দ্রাবানু, রাজুমালা, আলাল-দুলাল, আলোমতি, মধুমালা তামসা নাটকের জনপদ ছিল নেত্রকোণা সদর থানা সহ গোটা ময়মনসিংহ গীতিকা অঞ্চল। আর এ সবের কেন্দ্রস্থল ছিল নেত্রকোণা থানা। নেত্রকোণায় প্রায় প্রতিমাসে সে কালে বসত পালা নাটক (তামসা গান) এর দল। তখন ছেলেরা মেয়ে সেজে করত নায়িকার অভিনয়। গাডু গান ছিল নেত্রকোণার আদি লোক সংষ্কৃতির প্রধান আকর্ষণ। গাডু নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঝগড়া ফ্যাসাদ, খুন-খারাবী, মামলা-মোকদ্দমা হতেও শুনা যায় লোক মুখে। তাছাড়া বিয়ের গীত, উমের বাড়ীর গীতসহ মেয়েলী ভান্ডার ছিল নেত্রকোণা। একটি বিয়ের গীতের অংশ নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ
“আইজ দামান্দের খুশীর গোসল, অলদি বাইট্যা আনো
অলদির মধ্যে মেন্দি রং, ঘষইয়া ঘষইয়া তোলো”কবিয়ালঃ
কবিগান ছিল নেত্রকোণার গর্ব। নেত্রকোণা সদর থানার আমতলা গ্রামের লোচন, কর্মকার, দুগিয়ার রামদয়াল নাথ, বাংলার সহিলপুর গ্রামের বিজয় আচার্য্য, বেতাটীর কালী কুমার ধর, বুড়িঝুরীর আলী হোসেন সরকার, বেতাটীর আবুল সরকার ছিলেন নেত্রকোণার খ্যাতিমান কবিয়াল। আজ আর তাদের কেউ জীবিত নেই, শুধু জীবিত আছেন প্রায় অচল অবস্থায় সহিলপুর গ্রামের কবিয়াল মদন আচার্য্য। এক সময় কবিগানে সমৃদ্ধ ছিল নেত্রকোণা। আজ কবিগান বলতে গেলে বিলুপ্ত প্রায়।
নেত্রকোণার ভাষা ও সংস্কৃতির মধুরতম বাঁশরীগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিচে দেওয়া হলঃ
লোক সংষ্কৃতিতে মালজোড়া বাউল গানের স্রষ্টা হলো নেত্রকোণা। লালন ফকির, হাছন রাজা সবাই ছিলেন বৈঠকী বাউল। নেত্রকোণা পৌরসভার বাহরি চাপড়া গ্রামের বাউল রশিদ উদ্দিন, মালজোড়া বাউল গানের নির্মাতা। আর শিষ্য ছিলেন নেত্রকোণা থানার বাউল অন্ধ তৈয়ব আলী, বুড়িঝুড়ির আলী হোসেন সরকার, খাটপুড়ার বাউল চানমিয়া, শ্রীধরপুর গ্রামের মক্রম আলী। এছাড়াও দিরাই থানার বাউল শাহ্ আব্দুল করিমসহ বাউল রশিদ উদ্দিনের অসংখ্য বাউল শিষ্য নেত্রকোণা জেলাসহ গোটা ময়মনসিংহ গীতিকা অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিল। বাউল রশিদ উদ্দিন বাউল জগতে লালন ফকিবের জীবন দেবতার সন্ধান, হাছন রাজার অতৃপ্ত কামনার যন্ত্রনার চেতনার পাশে বাউল গানে বিদ্রোহ, কর্ম ও প্রকৃতির লীলা খেলার দর্শনের প্রবর্তক। তাঁর
“মানুষ বানাইয়া খেলছ তারে লইয়া
সেই মানুষ আবার কেমনে গোনাগার”
এমনি ধরণের সংখ্য গানে ফুটে উঠেছে বিদ্রোহের সুর। বাউল রশিদ উদ্দিন ২০০২ ইং সনে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক
“মানুষ, মানুষ ভজ, শুন বলিরে পাগল মন
মানুষের ভিতরে মানুষ, করিতেছে বিরাজন”।
গানটির জন্য মরনোত্তর পুরষ্কার প্রাপ্ত হন। নেত্রকোণা সদর থানার খাটপুড়ার বাউল আজাদ মিয়া, বুড়িঝুড়ির মুজিব সরকার ও নিজাম সরকার, সাতপাইয়ের বাউল হাকিম, ভদ্রপাড়ার বাউল ফিরোজ, কুনিয়ার বাউল ইসলাম উদ্দিন, রৌহার গোলাম মৌলা, সাতপাইল নিবাসী বাউল আনোয়ারা বেগম, রশিদ খরানা প্রথিতযশা বাউল শিল্পী।
পালাগীত, গাজীরগীত, জারিগান ও যাত্রাঃ
পালগীতকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় লাম্বাগীত। আর যারা গীত গায় তাদের বলা হয় গীতালূ। নেত্রকোণা থানার বাইড়াউড়া গ্রামের শান্তুমিয়া একজন খ্যাতিমান গীতালূ। আর গাজীর গীতের গাইন হলো মেদনীর নূরুল ইসলাম এবং নধার গ্রামের আব্দুল। জারিগানের খ্যাতিবার বয়াতী হলো বর্তমানে কয়রাটীর ছোয়াব আলী, হলুদ আটীর ফয়েজ উদ্দিন এবং কলস আটীর মজনু মিয়া। অতীতে অসংখ্য গীতালু, গাজীর গাইন ও বয়াতী ছিল নেত্রকোণা থানায়। যাত্রা জগতে কাঞ্চনপুরের প্রয়াত আঃ রহিম, কুনিয়ার প্রয়াত শামছু মিয়া এবং মদনপুরের মুখলেছুর রহমান ছিলেন দেশ বরেন্য যাত্রা শিল্পী। তবে সব লোক সংষ্কৃতি বর্তমানে প্রায় বিলুপ্তির পথে। গাডু গান, ঘুরমাগান, হাইর গান প্রায় বিলুপ্ত।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS